ইসলাম-পূর্ব আরব
The Pre-Islamic Arab
ইসলাম পূর্বযুগকে ‘আইয়ামে জাহেলিয়া’ বলা হয়। আরবি ভাষায় ‘আইয়াম’ শব্দের অর্থ সময় বা যুগ এবং ‘জাহেলিয়া’ শব্দের অর্থ তমসা, অজ্ঞতা, কুসংস্কার বা বর্বরতা। সুতরাং আইয়ামে জাহেলিয়া বলতে তমসার যুগ বা অজ্ঞতার যুগ (Age of Ignorance) বুঝায়। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে অর্থাৎ হযরত মুহম্মদ (স.)-এর জন্মের একশ বছর পূর্ব যুগকে আইয়ামে জাহেলিয়া বলা হয়। অধিকাংশ ঐতিহাসিকগণের মতে, “মুহম্মদ (স.)-এর পূর্ববর্তী এক শতাব্দীকালকে তমসার যুগ বলা যায়।” অধ্যাপক পি.কে. হিট্টিও এ মতের সমর্থন করেন।
জাহেলিয়া যুগের বৈশিষ্ট্য : ইসলাম পূর্বযুগে আরবদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনে নানা প্রকার কুসংস্কার, অনাচার ও বর্বরতা বিরাজিত ছিল। যার ফলে তারা মানবীয় গুণাবলি হারিয়ে অত্যাচার ও অবিচারের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছিল বলে এ কুসংস্কারবিশিষ্ট যুগকে অন্ধকারের যুগ বা ‘আইয়ামে জাহেলিয়া’ বলা হয়। ঐতিহাসিক P.K. Hitti-এর মতে, “The term Jahiliyah usually rendered. The time of ignorance or barbarism in reality means the period in which Arabia had no dispensation, no inspired prophet no tevealed-book.” Grits “সাধারণভাবে জাহেলিয়া শব্দের অর্থ অজ্ঞতার বা বর্বরতার যুগ বুঝায়; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, এটি সেই যুগকেই বুঝায় যে যুগে আরবে কোনো নিয়ম-কানুন ছিল না, কোনো নবির আবির্ভাব ঘটে নি এবং কোনো ঐশী কিতাব নাযিল হয় নি।”
পবিত্র কুরআনে বেশ কিছু আয়াত (৩ : ১৪৮, ৫ : ৫৫, ৩৩ : ৩৩, ৪৮ : ২৬) এ আইয়ামে জাহেলিয়া সম্পর্কে উল্লেখ আছে। কিন্তু সমগ্র আরব অঞ্চলে এর বিস্তৃতি ছিল কি না তা জানা যায় না। তবে আল্লাহ পবিত্র আল-কুরআনের সূরা আল ইমরানে বলেন, “তোমরা একটি ভীষণ অগ্নিকুণ্ডের প্রান্তসীমায় অবস্থান করছিলে।” (আয়াত : ১০৩)। এ আয়াত থেকে ইসলামের পূর্ব সময়কালকেই যে আইয়ামে জাহেলিয়া যুগ তা আমাদের নিকট স্পষ্ট।
প্রার্ক-ইসলামি আরব দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন বলতে কিছুই ছিল না। ছিল গোত্রভিত্তিক শাসন। শেখ শাসিত সমাজ ব্যবস্থায় আইনের শাসনের অভাব তীব্র থাকায় গোত্র বিদ্বেষ ছিল চরমে। নিম্নে তা আলোচনা করা হলো :
গোত্রভিত্তিক : অন্ধকারের যুগে আরব উপদ্বীপের রাজনৈতিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত নৈরাজ্যজনক ও বিশৃঙ্খলায় পরিপূর্ণ। কেন্দ্রীয় শাসন বলতে কিছুই ছিল না। সমগ্র উপদ্বীপে গোত্রভিত্তিক শাসন বিদ্যমান। গোত্রের বিদ্বেষ তাদের রাজনৈতিক জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। ঐতিহাসিক ওয়েল হাউসেন বলেন, “The religion of Arabs as well as their political life was no a throughly primative level.” অর্থাৎ, “আরবদের ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক জীবন সম্পূর্ণরূপে আদিম অবস্থায় ছিল।” তবে নিজ গোত্রের প্রতি তাদের আনুগত্য ছিল অপরিসীম।
শেখ শাসিত : গোত্রভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার ফলে গোত্রের প্রধান ছিল সর্বেসর্বা। গোত্রের প্রধানকে ‘শেখ’ বলা হতো। শেখদের মর্জির উপর শান্তি-শৃঙ্খলা নির্ভর করত। শেখদের স্বেচ্ছাচারিতার জন্য গোত্রগুলোর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম চলত। গোত্রের প্রধানের ইচ্ছায় অন্যান্য সদস্যের জীবন পরিচালিত হতো।
আইনের শাসন : সরকার গঠন বা শাসন পদ্ধতি সম্বন্ধে আরবরা অনভিজ্ঞ ছিল। নীতিবোধ ও সুস্থ জীবন যাত্রা সম্বন্ধে তাদের কোনো ধারণা ছিল না। ফলে দেশে কোনো বিধিবদ্ধ আইন না থাকায় “জোর যার মুলুক তার” বা “শক্তিই আইন” “Might is Right”— এ নীতি সর্বত্র প্রচলিত ছিল। রক্তের বদলে রক্ত (Blood for Blood), চক্ষুর বদলে চক্ষু, দাঁতের বদলে দাঁত নীতিতে তারা বিশ্বাসী ছিল। আইন না থাকায় ও তৃতীয় মীমাংসাকারী না থাকায় বনু বকর ও বনু তাঘলিব গোত্রের মধ্যে “বাসুরে যুদ্ধ” দীর্ঘদিন চলে। ঘোড়ার দৌড়কে কেন্দ্র করে আবস ও ধুবিয়ান গোত্রের মধ্যে দাবিস ও ঘাবড়ার যুদ্ধ যুগ যুগ ধরে চলতে থাকে ।
গোত্রে গোত্রে বিদ্বেষ : রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার জন্য গোটা আরব উপদ্বীপ ছিল নরকের রাজ্য। তাই ঐতিহাসিক গিবন বলেন, মহানবি (স.)-এর আবির্ভাবের পূর্বে আরবে বিভিন্ন গোত্রগুলোর মধ্যে প্রায় ১৭০০ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। দীর্ঘদিনব্যাপী এই সকল বিবাদ “আইয়ামে আল-আরব” বা আরবের দিন নামে পরিচিত।
মক্কার শাসন ব্যবস্থা : প্রাক-ইসলামি আরবে মালা নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠন বা মন্ত্রণা সভা ছিল। বিভিন্ন বিবদমান গোত্রের প্রধানদের নিয়ে এ মন্ত্রণা সভা গঠিত হয়েছিল— যার উদ্দেশ্য ছিল শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা, গোত্রীয় ভারসাম্য রক্ষা করা এবং মৈত্রী ও সদ্ভাব কায়েম করা। মন্ত্রণা পরিষদের শুধুমাত্র পরামর্শ প্রদানের ক্ষমতা ছিল, কোনো কার্যনির্বাহী ক্ষমতা ছিল না। ‘দার-আন-নাদওয়া’ নামে ‘মালার’ একটি সভাকক্ষ ছিল
সামাজিক অবস্থা
সমাজ জীবন ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। নৈতিক অবস্থার অধঃপতনের ফলে সমাজের সর্বস্তরে কলুষিত, পাপাচার, অন্যায়-অবিচারে ভরে যায়। নিম্নে এ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা করা হলো :
অন্যায় ও অবিচার : ইসলাম-পূর্ব আরব দেশের সামাজিক ও নৈতিক অবস্থা ঘোর অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল। পাপাচার, কুসংস্কার, অন্যায়-অবিচার আরব সমাজকে কলুষিত করেছিল। ঐতিহাসিক খোদাবখশ্ বলেন, “আরবগণ মদ, নারী ও যুদ্ধবিদ্যায় লিপ্ত থাকত এবং মুহম্মদ (স.) সমগ্র আরবকে মূর্খতা, বর্বরতা ও প্রকৃতি পূজায় নিমজ্জিত দেখতে পান।” “War, woman and wine were the three absorbing passions of the Arabs . ” তিনি আরও বলেন, “Arabia as Muhammad found it, was steeped in ignorance, barbarism and fetishism of the worst type.”
নারীর অবস্থা : নারী জাতি ছিল ঘৃণিত, অবহেলিত এবং ভোগের সামগ্রী। বিবাহের রীতি বলতে কিছুই ছিল না। তাই তারা সন্তান লাভের জন্য স্বামীর নিকট হতে অনুমতি নিয়ে পরপুরুষের সঙ্গে মেলামেশা করত। বিমাতাকে বিবাহ, ভগ্নীকে বিবাহ সমাজে প্রচলন ছিল। নারী পণ্যদ্রব্যের ন্যায় হাটে-বাজারে বিক্রয় হতো। মৃত স্বামী ও পিতার অথবা কোনো আত্মীয়ের সম্পদে তাদের কোনো অংশ ছিল না। কন্যা সন্তান জন্মদান অপমানজনক বিধায় তাদেরকে জীবন্ত কবর দেওয়া হতো। কিতাবুল আঘাজির মতে, “এই জঘন্য প্রথা কায়েস-বিন-আসিম নামে জনৈক ব্যক্তি প্রবর্তন করেন।” ঐতিহাসিক খোদাবখশ্ বলেন, “আরববাসীরা সুরা, নারী ও যুদ্ধে লিপ্ত থাকত।” বহু পিতা দারিদ্র্যের ভয়ে কন্যা সন্তানকে হত্যা করত । এ অমানবিক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকা পবিত্র কুরআনে বিঘোষিত হয়েছে, “এবং তুমি তোমার সন্তানদিগকে দারিদ্র্যের ভয়ে হত্যা করো না। আমি তাদের এবং তোমাদের জীবিকা সরবরাহ করে থাকি। নিশ্চয় তাদের হত্যা করা মহাপাপ। ” [আল-কুরআন (১৭ : ৩৯)]
দাস-দাসীর অবস্থা : ক্রীতদাস প্রথা আরব সমাজকে কলঙ্কিত ও কলুষিত করেছিল। ক্রীতদাসগণ ছিল পশুর সমতুল্য। হাটে- বাজারে অবাধে কেনা-বেচা হতো। তাদের কোনো প্রকার স্বাধীনতা ছিল না। মনিবের মর্জির উপর তাদের জীবন পরিচালিত হতো। অমানবিক নির্যাতন সহ্য করে তাদের জীবন যাপন করতে হতো। দাস-দাসীদের বিবাহ ছিল অবৈধ এবং লঙ্ঘন করা ভীষণ দণ্ডনীয় অপরাধ ছিল। ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন, “ভৃত্যই হোক আর ভূমিদাসই হোক ভাগ্যে ক্ষীণ আশা বা এককণা সূর্যরশ্মিও কবরের এদিকে (ইহজীবনে) জুটত না ৷ ”
মদ-জুয়ার প্রচলন : জাহেলিয়া সমাজ ব্যবস্থায় মদ ও জুয়া ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। জুয়ার চালে ঘরের স্ত্রী পর্যন্ত ধরার প্রচলন ছিল। যারা জুয়া খেলত না তাদের কৃপণ ও ছোটলোক মনে করা হতো। মদ ও নর্তকী ছাড়া আরব সমাজে উৎস কল্পনা করা যেত না। মদ খেয়ে ও উন্মাদ হয়ে অশ্লীল কর্ম করতে তারা ছিল অভ্যস্ত। আরবে মাসব্যাপী বিখ্যাত উকা বসত। মদ ও জুয়ার জন্য ঐ মেলা বিখ্যাত ছিল।
নৈতিক অবক্ষয় : ইসলাম পূর্ব আরব দেশের মানুষের নৈতিক অধঃপতনই আরব সমাজকে কলুষিত করেছিল। পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতা, আভিজাত্যের দম্ভ, নারী হরণ, চুরি ইত্যাদি গর্হিত কার্য সংঘটিত হতো আরব সমাজে।
নিষ্ঠর কুসীদ প্রথা : ইসলাম পূর্বযুগে আরব সমাজে সুদ প্রথা বিদ্যমান থাকায় জনজীবন বিপর্যস্ত ছিল। সুদের দায়ে জনসাধারণের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করা হতো। এমনকি স্ত্রী-পুত্র, কন্যাকে দখল করা হতো। লুটতরাজ ছিল আরব সমাজের এক শ্রেণির মানুষের পেশা। মানুষ ও প্রাণীকে শাস্তি দিয়ে তারা শান্তি পেত। মোরগের লড়াই ও ঘোড়দৌড় ছিল প্রধান খেলা।
অতিথিপরায়ণতা : আরব সমাজে নৈতিক অবক্ষয় ও বিশৃঙ্খলা থাকলেও সমাজে অতিথিদের ব্যাপারে লোকেরা একনিষ্ঠ ছিলেন। তাদের সেবাযত্ন, আশ্রয় দান, আপ্যায়নের ক্ষেত্রে আন্তরিকতা ছিল বড় বৈশিষ্ট্য ।
অর্থনৈতিক অবস্থা
প্রাক-ইসলামি আরবের অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন ছিল তা নিম্নে আলোচনা করা হলো :
প্রাকৃতিক পরিবেশ : প্রকৃতিগত দিক থেকে আরব দেশ ছিল শুষ্ক আবহাওয়া, বালু আর পাহাড়ে ঘেরা। এ কারণে কোনো প্রকার গাছপালা ও শস্য সেখানে উৎপাদিত হতো না। ফলে আরব দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল দুর্গতিপূর্ণ। প্রধানত তিন শ্রেণির লোক সেখানে বসবাস করত। মরুবাসী যাযাবর, শহরবাসী, ব্যবসায়িক শ্রেণি ও সুদ ব্যবসায়ী।
জীবিকা নির্বাহ : মরুবাসী বেদুইন সম্প্রদায় যাদের জীবনযাত্রার মান নিম্নমানের। কঠোর পরিশ্রম করে পশুপালন করত আর তাদের পেশা ছিল লুণ্ঠন। অপর শ্রেণি ছিল শহরবাসী। তাদের জীবিকা ছিল ব্যবসায় কিন্তু অর্থনৈতিক সংকট তাদের নৈতিক জীবনকে কলুষিত করে। ভারতে মসলা-সুগন্ধির ব্যবসায় ছিল আরবদের জীবিকার অন্যতম উৎস এবং ভারতবর্ষ আরবদের বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হয়। মক্কার কুরাইশরা এই বাণিজ্যে বিশেষ ভূমিকা রাখে। বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপনে যে চুক্তি সম্পাদিত হতো তা-ই লাফ (Laf) নামে পরিচিত।
সুদভিত্তিক অর্থনৈতিক অবস্থা : আরব সমাজে সুদ ব্যবসায়ীরা নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থাকে ভালো করলেও সামগ্রিক অর্থ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে। অধিকাংশ লোক সুদের কারণে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে
অর্থকরী সম্পদ : তৎকালীন আরবে কোনো অর্থকরী ফসল বা প্রাকৃতিক সম্পদ ছিল না। খেজুর, যব, বার্লি এসব ছিল আরবের ফসল। পশু ছিল বেদুইনদের একমাত্র আয়ের উৎস। খেজুর, যব, পশুর মাংস ও দুধ ছিল তাদের প্রধান খাদ্য । ফলে তাদের জীবনযাত্রার মান ছিল অত্যন্ত করুণ। কঠোর দরিদ্রতার সঙ্গে সংগ্রাম করে তাদের বেঁচে থাকতে হতো ।
প্রশ্ন: ইসলাম পূর্বযুগে আরবের নারীর অবস্থা বর্ণনা কর ।
প্রশ্ন: -পূর্ণ আরবের আর্থ-সামাজিক চিত্র তুলে ধর।
প্রশ্ন: ধর্মীয় অবস্থা কি
প্রাক-ইসলামী ধর্মীয় অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় ছিল। নিম্নে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :
বিভিন্ন ধর্ম মতাবলম্বী : প্রাক-ইসলামি যুগে আরবের ধর্মীয় অবস্থা রাজনৈতিক অবস্থার মতোই তমসাচ্ছন্ন ছিল। জাহেলিয়া যুগে আরবে মোট পাঁচ প্রকার ধর্মাবলম্বী লোক বাস করত— ইহুদি, খ্রিষ্টান, জরোস্ট্রীয় ধর্ম, মূর্তি উপাসক আরববাসী এবং হানিফা সম্প্রদায় ।
পৌত্তলিক পূজারি : হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও হযরত ইসমাইল (আ.) প্রবর্তিত আল্লাহর একতৃবান বিলুপ্ত হয়ে ক্রমাধয়ে আরব দেশ পৌত্তলিকতায় ভরে যায়। খ্রিষ্টান ও ইহুদি ছাড়া আরবের সকল অধিবাসীই “গৌত্তলিক পূজারি” ছিল। তারা বিভিন্ন প্রকার মূর্তি প্রস্তুত করে তাদের প্রভুজ্ঞানে পূজা করত। তাদের উপাস্য দেব-দেবীর আকৃতি নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী তৈরি হতো।
ইহুদি সম্প্রদায় : হযরত মুসা (আ.)-এর অনুসারী ইহুদিগণ তাদের নবির শিক্ষা ভুলে গিয়ে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে এক নৈরাশ্যজনক অবস্থার সৃষ্টি করেছিল। ইহুদিগণ অজ্ঞানতাবশত “জেহোবাকে’ বিশ্বজগতের স্রষ্টা ও নিয়ন্তা মনে করত। জরোস্ট্রীয় ধর্ম : জরোস্ট্রীয় ধর্মে কতিপয় লোক বিশ্বাসী ছিল। এ ধর্মের বিষয়বস্তু ছিল বিশ্বজগৎ “আহোরা মাজদা” (Ahura Mazda) ও আহরিমন (Ahriman) নামে দুটি পরস্পর বিরোধী শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। প্রথমটি মঙ্গলের দেবতা প্রতীক হলো অগ্নি। দ্বিতীয়টি অমঙ্গলের দেবতা। তাই তাদের অগ্নি উপাসকও বলা হয়।
খ্রিষ্টান সম্প্রদায় : ইহুদি ধর্মের ন্যায় আরবে খ্রিষ্টধর্মও প্রচলিত ছিল। খ্রিষ্টানরা এক আল্লাহর পরিবর্তে ‘ত্রিত্ববাদে বিশ্বাসী ছিল। তাদের মতে আল্লাহর স্ত্রী বিবি মরিয়ম এবং ঈসা (আ.) তাঁর পুত্র ।
সৌরজগতের পূজা : আরবা সকল দেব-দেবীর পূজা করত। মূর্তি পূজা ছাড়াও তারা চন্দ্র, সূর্য, তারকারাজির এমনকি সৌরজগতের পূজা করত ।
কাবাগৃহে দেব-দেবী স্থাপন : আরবের এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়ের দেবতাকে পূজা করতে অপমান বোধ করত। পবিত্র কাবাগৃহে বিভিন্ন গোত্রের পৌত্তলিক পূজারিগণ ৩৬০টি মূর্তি রেখে তাদের আল্লাহ জ্ঞানে পূজা করত। তারা ‘আসাফ’ ও ‘নামিলা’ নামক মূর্তিদ্বয়কে যথাক্রমে সাফা ও মারওয়া পর্বতে স্থাপন করে সেখানে হজের সময় পশু বলি দিত। তারা হযরত ইব্রাহিম ও হযরত ইসমাইল (আ.), হযরত ঈসা (আ.) এবং বিবি মরিয়ম (আ.)-এর মূর্তি কাবাগৃহে স্থাপন করেছিল। নসর, লাৎ, হুবাল, মানাৎ, আল উজ্জাহ তাদের প্রিয় দেব-দেবী ছিল। প্রতি বছর বহু লোক এ সকল দেব-দেবীর পূজা করতে আসত ।
ধর্মীয় কুসংস্কার ও অনাচার : পৌরহিত্য, জীবজন্তু ও মানুষ বলিদান, মন্ত্র-তন্ত্র, যাদু-টোটকা প্রভৃতি কুসংস্কারে প্রাক-ইসলামি আরববাসীরা আচ্ছন্ন ছিল। ভূত-প্রেত ও ভবিষ্যৎ বাণীতে তারা বিশ্বাসী ছিল। অতীত কিংবা ভবিষ্যৎ নয়, বরং বর্তমানই তাদের নিকট চরম ও পরম বলে বিবেচিত হতো। আরববাসীরা আল্লাহর একত্ব, আত্মার অমরত্ব এবং শেষ বিচারের দিনকে বিশ্বাস করত না।
বিভিন্ন মতবাদ : ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরবে ইহুদি, খ্রিষ্টান, জরোস্ট্রীয় প্রভৃতি ধর্মমত প্রচলিত ছিল। কিন্তু এসব ধর্মমত আরববাসীদের সর্বশক্তির উৎস আল্লাহর প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাসে উজ্জীবিত করে তুলতে পারে নি।
হানিফা সম্প্রদায় : পৌত্তলিক পূজারি, ইহুদি ও খ্রিষ্টধর্মের নিষ্পেষণে আরবের ধর্মীয় অবস্থা চরম আকার ধারণ করলেও এ সময় ‘হানিফা’ নামীয় মদিনার এক সম্প্রদায় অস্পষ্টভাবে একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী ছিল। জায়েদ-বিন-আমর, ওয়ারাকা-বিন- নওফেল, ওয়ালিদ-বিন-মুঘিরা প্রমুখ ব্যক্তি এ সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন।
ইসলাম-পূর্ব আরবের সাংস্কৃতিক অবস্থা ভালো থাকলেও ধর্মীয় অবস্থা শোচনীয় ছিল। এ চরম দুর্গতিসম্পন্ন জাতিকে পরিত্রাণের জন্য একজন ত্রাণকর্তার আবির্ভাব অত্যাবশ্যক হয়ে দেখা দেয়। ঐতিহাসিক আমীর আলী ঠিকই বলেছেন, “পৃথিবীর ইতিহাসে পরিত্রাণকারীর আবির্ভাবের এত বেশি প্রয়োজন এবং এমন উপযুক্ত সময় অন্যত্র অনুভূত হয় নি।” পরিশেষে বলা যায়, প্রাক-ইসলামি যুগে আরবদের রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন শক্তিশালী ছিল। তাদের ব্যবসায়-বাণিজ্য শুধু মক্কাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তারা বহিঃবাণিজ্য সিরিয়া, পারস্য ও ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন এলাকায় করত। বিশেষ করে মক্কার লোকেরা ব্যবসায়-বাণিজ্যে উন্নত ছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, হযরত খাদিজা (রা.), হযরত ওসমান (রা.), আবু সুফিয়ানসহ আরবের ধনিক শ্রেণি ব্যবসায় করত। তবে সুদের ব্যবসায় মানুষকে সর্বস্বান্ত করে তুলত। তাই বলা যায়, প্রাক-ইসলামি যুগে আরবরা ব্যবসায়-বাণিজ্যে উন্নত ছিল।
যৌথ কাজ : ইসলাম-পূর্ব আরব অধিবাসীদের ধর্মীয় বিশ্বাসগুলোর একটি তালিকা তৈরি কর।
সাংস্কৃতিক অবস্থা
প্রাক-ইসলামি আরব দেশের সাংস্কৃতিক অবস্থা কেমন ছিল তা জানার জন্য বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :
আরবের বৈশিষ্ট্য : “আইয়ামে জাহেলিয়া” বা “অজ্ঞতার যুগে” আরবেরা একেবারে কৃষ্টিজ্ঞান বিবর্জিত ছিল না। বর্তমান যুগের ন্যায় শিক্ষা পদ্ধতি প্রচলিত না থাকলেও তারা সাংস্কৃতিক জীবনযাত্রা হতে একেবারে বিচ্ছিন্ন ছিল না। তাদের ভাষা ও কবিতার জন্য তারা বিখ্যাত ছিল। প্রখর স্মৃতিশক্তি ও অপূর্ব বাগ্মিতার জন্য তারা ইতিহাসে সুখ্যাতি অর্জন করে। আরবদের কবিতা (গীতিকাব্য) কাসিদা নামে পরিচিত : গীতিকাব্য রচনা ও সাহিত্য চর্চায় আরবদের অপূর্ব সৃজনশীল শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। আরবদের কবিতা ‘কাসিদা’ নামে খ্যাত ছিল। গ্রিকগণ যেমন সাহিত্য ও ভাস্কর্যের জন্য গৌরব অনুভব করে, তেমনি আরবগণও তাদের কাসিদা ও গীতিকাব্যের জন্য কৃতিত্বের দাবি রাখে ৷
উন্নত ভাষা : ঐতিহাসিক হিট্টি এ কাসিদাগুলোর কাব্যিক মূল্য নির্ণয় প্রসঙ্গে বলেন, “এ কাশিদাগুলো ছন্দ এবং বিশদ ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে ইলিয়ড এবং ওডেসিকেও অতিক্রম করেছে।” প্রাক-ইসলামি যুগে আরবদের ভাষা এত সমৃদ্ধশালী ছিল যে, আধুনিক ইউরোপের উন্নত ভাষাগুলোর সাথে তার তুলনা চলত। তাদের উন্নত ভাষা সম্বন্ধে পি.কে. হিট্টি বলেন, “ইসলামের জয় অনেকাংশে একটি ভাষার জয়, আরও সুস্পষ্টরূপে বলতে গেলে একখানি কেতাবের জয়ই ইসলামের জয়।” তাঁর মতে, “এই (আরবি) ভাষাই মধ্যযুগে বহু শতাব্দী ধরে সভ্য বিশ্বের সর্বত্র শিক্ষা, সংস্কৃতি ও প্রগতি চেতনার বাহক ছিল।” আরবি ভাষা যে কত সমৃদ্ধশালী ছিল তার জ্বলন্ত প্রমাণ ঐশীগ্রন্থ কুরআন
সাহিত্য চর্চা : প্রাক-ইসলামি যুগে আরবদের মধ্যে যে সাহিত্য চর্চা প্রচলিত ছিল ‘উকায মেলা’ তার একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন। পি.কে. হিট্টি বলেন, “পৃথিবীতে সম্ভবত অন্য কোনো জাতি আরবদের ন্যায় সাহিত্য চর্চায় এত স্বতঃস্ফূর্ত আগ্রহ প্রকাশ করে নি এবং কথিত বা লিখিত শব্দ দ্বারা এত আবেগাচ্ছন্ন হয় নি।” এ সমস্ত সাহিত্য আসরে কবিতা পাঠ, সাহিত্য বিষয়ক আলোচনা ও সমালোচনা অনুষ্ঠিত হতো ।
মুয়াল্লাকাত ও গাঁথা গ্রন্থ : মাসব্যাপী উকাযের বাৎসরিক মেলায় কবিতা পাঠের প্রতিযোগিতা ইসলাম-পূর্ব আরবের একটি বিখ্যাত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এই মেলায় পুরস্কার প্রাপ্ত সাতটি কবিতা সোনালি অক্ষরে লিপিবদ্ধ করে ‘কাবা’ ঘরের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা হতো বলে কবিতাগুলোকে ‘মুয়াল্লাকাত’ বলা হয়। আমর, লাবিদ, আনতারা, ইমরুল কায়েস, তারাফা, হারিস ও জুবাইর ছিলেন এ কবিতাগুলোর স্বনামধন্য রচয়িতা। সে যুগে অসংখ্য গাঁথা, সাহিত্য ও কাব্যগ্রন্থ প্রণীত হয়। হিট্টি উকাযের মেলাকে “আরবের Academic Francaise” বলে অভিহিত করেছেন ।
বিজ্ঞানের চর্চা : সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি আরবরা বিজ্ঞান চর্চাও করত। চিকিৎসাবিদ্যা, পশু চিকিৎসা, জ্যোতির্বিদ্যা, বায়ুপ্রবাহের দিক নির্ণয় এবং বৃষ্টিপাতের সময় নির্ণয় বিষয়ে আরবদের বিশেষ আগ্রহ ছিল। এতদ্ব্যতীত তাদের মধ্যে গীতবার্দ্যের চর্চাও জনপ্রিয় ছিল।
কবিতার মাধ্যমে সাংস্কৃতিক চেতনা : জাহেলিয়া যুগে কবিগণ তাঁদের গোত্র ও গোত্রীয় বীরদের বীরত্বপূর্ণ কাহিনী, বিবরণ, উটের বিস্ময়কর গুণাবলি এবং সর্বোপরি সুন্দরী নারী ও প্রেমিক-প্রেমিকাদের নিয়ে কবিতা রচনা করতেন। তাঁদের যুদ্ধের এ সমস্ত কবিতা সুদূর যুগের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এককথায় আরব জীবনের সুখ-দুঃখ, ধ্যানধারণা, রীতি- নীতি ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রকাশের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিল আরবি কবিতা। তাই ঐতিহাসিক আল্লামা স্যুয়ুতি (র.) বলেন, “কবিতা আরবদের সার্বজনীন পরিচয়ের স্বাক্ষরিত দলিল।” ঐতিহাসিক হিট্টির মতে, “কাব্যপ্রীতি ছিল বেদুইনদের সাংস্কৃতিক দলিল।” কবিতার মাধ্যমে তাদের সাহিত্য প্রতিভার বিকাশ ঘটত।
স্বনামধন্য কবি : ইমরুল কায়েস, তারাফা-বিন-আল আবাদ, হারিস বিন-হিল্লিজ, আন তারা-বিন সাদাত এবং আমর-বিন কুলসুম প্রাক-ইসলামি যুগের কবিদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিলেন। ইমরুল কায়েস ছিলেন কবিদের আমীর। তাঁকে “আরবের শেক্সপিয়র” বলা হতো। সে যুগে লিখন প্রণালির যথেষ্ট উন্নতি সাধিত হয় নি বলে আরবগণ তাদের রচনার বিষয়বস্তু মুখস্থ করে রাখত। তাদের স্মরণশক্তি ছিল প্রখর। তারা মুখে মুখে কবিতা পাঠ করে শুনাত। এ সম্বন্ধে ঐতিহাসিক নিকলসন বলেন, “সে যুগে কবিতা কিছুসংখ্যক সংস্কৃতিমনা লোকের বিলাসিতার বিষয়বস্তু ছিল না, বরং তা ছিল তাদের ভাব-প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম। ”
গদ্য রচনা, প্রবাদ বাক্য ও বাগ্মিতা : প্রাক-ইসলামি যুগের— বংশ-গোত্র দ্বন্দ্ব, গোত্র বিদ্রোহ ইত্যাদি সংবলিত কিছু গদ্য গোত্রপ্রীতি, আতিথেয়তা, সরলতা, স্বাধীনতা, স্পৃহা, ধর্মপ্রবণতা, বদান্যতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, বীরত্ব, স্মৃতিশক্তি, কর্মক্ষমতা ও কাব্যানুরাগ চরিত্রের প্রশংসনীয় ও বিরল গুণাবলির জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত।
মৌলিকত্ব : ইসলাম-পূর্ব আরবদের জীবনধারা, আচার-অনুষ্ঠান, ধ্যানধারণা প্রভৃতি ছিল নিতান্ত আদিম, অবিকৃত ও স্বকীয়তায় পরিস্ফুট। যোসেফ হেল বলেন, “What civilization we find there (Arabia, is their own unaffected indigenous civilization.