Homeইতিহাসগ্রিক সভ্যতা (The Greek Civilization ) 

গ্রিক সভ্যতা (The Greek Civilization ) 

গ্রিক সভ্যতা (The Greek Civilization ) 

ইন্দো-ইউরোপীয় গোষ্ঠীভুক্তরা ছিল গ্রিকদের আদি পুরুষ। মূলত এরা আর্যগোষ্ঠী সম্ভূত। এদের আদি নিবাস দানিউব নদীর তীরে অবস্থিত তৃণভূমি অঞ্চল থেকে ইজিয়ান পর্যন্ত। খ্রিষ্টপূর্ব ১১৫০-১০০০ অব্দে মূল গ্রিস ডোরীয়দের অধিকারে আসে। ডোরীয়দের সংমিশ্রণে ধীরে ধীরে একটি শক্তিশালী জাতির অভ্যুদয় হয়। তারা সে অঞ্চলে এক সভ্যতা গড়ে তোলে। এ সভ্যতাই গ্রিক সভ্যতা। গ্রিকগণ মূলত দুভাগে বিভক্ত। যথা : (1) লেলেনিক (২) হেলেনিস্টিক।

হেলেনিকগ্রিক সভ্যতার আদিপর্ব এর মূলকেন্দ্র ছিল গ্রিক উপদ্বীপ। হেলেনিক সভ্যতার প্রধান কেন্দ্র ছিল এথেন্স। গ্রিক সংস্কৃতির মধ্যে অ-গ্রিক উপাদান সংমিশ্রিত হলে তখনই উদ্ভব হয় হেলেনিস্টিক যুগ। খ্রিষ্টপূর্ব ১৪৬ এ হেলেনিস্টিক যুগের সূত্রপাত হয় ৷

বিশ্বসভ্যতার উন্মেষ ও বিকাশ সাধনে গ্রিকদের অবদান ছিল অসামান্য। ইতিহাসের জনক হিরোডোটাস, জগদ্বিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিস, এরিস্টটল, প্লেটো, নন্দিত বিজ্ঞানী পিথাগোরাস, আর্কিমিডিস, ইউক্লিড, হিপোক্রেটস গ্রিসে জন্মগ্রহণ করে গ্রিসকে ধন্য করেছেন। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-সংস্কৃতির ব্যাপক অনুধাবন ও চর্চা করে নতুন সভ্যতার উদ্ঘাটন করেছেন। বিশ্বব্যাপী এর অসামান্য প্রভাবের ফলে জ্ঞানের সকল শাখা পরিপুষ্টি লাভ করেছে। বিশ্বখ্যাত কবি শেলী যথার্থই বলেন, “আমরা সবাই গ্রিক, আমাদের আইন, আমাদের সাহিত্য, আমাদের কলা— এগুলোর (সকলের) মূলে রয়েছে গ্রিস। ”

দেশ ও সমাজ: – প্রাচীন গ্রিসে কোনো একক রাষ্ট্র ছিল না। প্রতিরক্ষার প্রয়োজনে দুর্গ দ্বারা সুরক্ষিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নগররাষ্ট্রের সমন্বয়ই ছিল গ্রিক রাষ্ট্র। বস্তুত সুরক্ষিত অঞ্চলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে থাকে নগর এবং নগরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে থাকে সরকার ব্যবস্থা। এভাবেই গ্রিক নগররাষ্ট্রের উত্থান ও বিকাশ হতে থাকে। গ্রিসের মূল ভূখণ্ডে এথেন্স, থিবস, মেগরা, গেলোপনেসাস অঞ্চলে স্পার্টা এবং কোরিন্থ, এশিয়া মাইনরের তীরে মিলেটাস প্রভৃতি। জনসংখ্যাও সীমারেখার দিক থেকে নগররাষ্ট্রসমূহ ছিল বিভিন্ন প্রকৃতির। নগররাষ্ট্রসমূহের মধ্যে বিখ্যাত ছিল এথেন্স ও স্পার্টা। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬০ অব্দে পেরিক্লিসের শাসনামলে এথেন্স গৌরবের শিখরে আরোহণ করে। খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০ অব্দ থেকে হোমারিক যুগে গোত্রীয় লোকেরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিধিবদ্ধ সমাজ গড়ে তোলে। এরা অভিজাত, মধ্যবিত্ত এবং কৃষক, কারিগর ও বণিকশ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। শাসনব্যবস্থা : প্রাচীন মিসরীয় পদ্ধতির অনুকরণে নগররাষ্ট্রসমূহের সরকার ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। একটি বিধিবদ্ধ কাউন্সিলের মাধ্যমে দুজন রাজা রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন। রাজারা সামরিক, ধর্মীয় ও আইনগত বিষয়ের নেতৃত্ব দিতেন। প্রশাসনিক কার্যক্রম, সভা আহ্বান, ফৌজদারি আদালতের কার্যাবলিও পর্যবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধান করতেন।

অর্থনৈতিক জীবন : খ্রিষ্টপূর্ব ৫৯৪ অব্দে সোলোন নামে জনৈক সংস্কারক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করেন। তিনি সব কৃষকের ঋণ মওকুফ ও ভূমি রাজস্ব সংস্কার করে অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ভূমির সাথে সম্পৃক্ত শ্রমিকশ্রেণি ‘হেলট’রাই ছিল কৃষি উৎপাদনের মূল শ্রমশক্তি। তাদের শ্রমশক্তিই গ্রিসের অর্থনৈতিক জীবনের আধার ছিল। সীমিত পরিসরে অর্থকাঠামোর সহায়ক শক্তি ছিল বাণিজ্য ও শিল্প। বাণিজ্য ও শিল্প পেরিওয়েসি শ্রেণির নিয়ন্ত্রণে ছিল।

ধর্মবিশ্বাস : ধর্ম ও দর্শনে গ্রিকরা অগ্রগামী ছিল। প্রাচীন গ্রিকদের মধ্যে দেব-দেবী পূজার প্রচলন ছিল। দেবতাগণ মহিমান্বিত ব্যক্তিত্ব, পার্থিব ও লোভী বিবেচিত ছিল। জিউস ও এথেনা প্রধান দেব-দেবীর ভূমিকায় অধিষ্ঠিত ছিল। ধর্মীয় আরাধনা হিসেবে ধর্ম শোভাযাত্রা, প্রার্থনা, বিভিন্ন দ্রব্য উৎসর্গ, ধর্ম ভোজের ব্যবস্থা প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত ছিল। এভাবে দেবতাগণ গ্রিকদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল। অলিম্পিক খেলাধুলাকেও ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের অপরিহার্য অঙ্গ জ্ঞান করা হতো।

দর্শন : দর্শনের ক্ষেত্রে গ্রিকদের অবদান ছিল অসামান্য। বিশ্বখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিস, এরিস্টটল ও প্লেটো প্রাচীন গ্রিসেই জন্ম লাভ করেন। এঁরা বিশ্বমানব, বিশ্ব মানবাত্মা, দেবতাদের একাত্মতা, মানুষের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জীবন সম্পর্কে অতীব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও তত্ত্ব প্রদান করে গেছেন। বিজ্ঞান ও নীতিশাস্ত্রের অগ্রগতি সাধনে তাদের সবিশেষ অবদান রয়েছে।

স্থাপত্য : মন্দির ও বাসগৃহকে উপজীব্য করে নগররাষ্ট্রগুলো সুশোভিত হয়ে উঠেছিল। কাঠ ও রৌদে পোড়ানো ইট দ্বারা ডোরীয়, আয়োনীয় ও করিন্থীয় পদ্ধতিতে জমকালো মন্দির ও প্রাসাদ নির্মাণ করত। মন্দির ও প্রাসাদ ছাড়া লাইব্রেরি, জাদুঘর, আলোক গৃহ ও থিয়েটার গৃহ নির্মাণ করেছিল। মেঝেতে মোজাইক ও দেয়ালচিত্র অঙ্কনের মাধ্যমে স্থাপত্যকর্মকে সুষমামণ্ডি সুষমামণ্ডিত করে তুলত ।

চিত্রকলা ও ভাস্কর্য : শিল্পকলা, স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চারু-কারু কর্মে গ্রিকগণ অপূর্ব শিল্প নৈপুণ্য ও দক্ষতার স্বাক্ষর রেখে “গেছেন। গ্রিক শিল্পকলা আর্কেয়িক, হেলেনিক শিল্পকলা গ্রহণ করেছিল। প্রাচীন গ্রিকগণ বাঁশি বাজাতে জানতেন এবং বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্রের প্রচলন ছিল। পিথাগোরাস বিজ্ঞানসম্মতভাবে গানের সুর-লয়-তাল সৃষ্টিতে অবদান রাখেন। চিত্রকলা ও ভাস্কর্য শিল্পেও প্রাচীন গ্রিক সভ্যতা অমূল্য অবদান রেখেছিল। চিত্র শিল্পীরা কলসে বিভিন্ন জীবজন্তু ও চিত্তাকর্ষক ছবি অঙ্কন করত। আলেকজান্ডারের সময় চিত্রশিল্পী এ্যাপেলেস চিত্রাঙ্কনের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। চিত্র ছাড়াও গ্রিসের শিল্পীরা ভাস্কর্য শিল্পেও উৎকর্ষ সাধন করেছিলেন। তারা পাথর খোদাই করে মানুষ, শকট, ঘোড়া প্রভৃতির অবিকল প্রতিকৃতি তৈরিতে সিদ্ধহস্ত ছিল।ইতিহাস ও সাহিত্যের জগৎকে পুরিপুষ্টি সাধনে গ্রিকদের অবদান বিস্ময়কর। কিছু অক্ষর সংযোজন ও বিয়োজন করে গ্রিক সাহিত্যিকগণ ফিনিসীয়দের অক্ষরসমূহ গ্রহণ করেছিল। বিখ্যাত সাহিত্যিক হোমার সে যুগে ‘ইলিয়ড’ ও ‘ওডিসি’ নামক মহাকাব্য রচনা করে অমরত্ব লাভ করেন। গীতিকাব্য ও নাটক রচনার ক্ষেত্রে গ্রিক সাহিত্যিকদের মুড়ি মেলা ভার ছিল। ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রেও গ্রিকগণ খ্যাতি অর্জন করে। ইতিহাসের জনক ‘হিরোডোটাস ও ইতিহাসবেত্তা থকিডাইডিস ইতিহাস রচনায় নতুন মাত্রা সংযোজন করেন।

জ্ঞান-বিজ্ঞান : বিজ্ঞান সাধনার ক্ষেত্রে গ্রিক পণ্ডিতদের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। গ্রিক দর্শনের বিকাশের মধ্যদিয়ে যে যুক্তিনির্ভর বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটেছিল, বিজ্ঞানের উন্নয়নে তার ভূমিকা মুখ্য ছিল। প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ, পৃথিবীর জন্ম রহস্যের উদ্ঘাটন, সূর্যগ্রহণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে থালেস প্রমুখ বিজ্ঞানীদের অবদান রয়েছে। গ্রিক গণিতবিদ পিথাগোরাস বিশ্ববিখ্যাত গণিতজ্ঞ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। জ্যামিতির উন্নয়নে তার অবদান অনস্বীকার্য। তিনিই গাণিতিকভাবে প্রমাণ করেছেন যে, পৃথিবী বৃত্তাকার। গ্রিক ভূগোলবিদ এরাসটোফেন পৃথিবীর পরিধি ও দৈর্ঘ্য নির্ধারণ করেন। গ্রিক বিজ্ঞানী এনাক্সোগোরাস প্রথম ধারণা দেন যে, সূর্য হচ্ছে উত্তপ্ত ও পাথরের গলিত পিণ্ড এবং চন্দ্র সূর্যের আলোতেই আলোকিত । চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও হেলেনীয় যুগে যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হয়েছিল। হিপোক্রাটস ছিলেন এ যুগের বিখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী। তিনি শরীরবিদ্যার উপর গবেষণা করে রোগের প্রকৃতি নির্ণয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। চিকিৎসাবিদ হিরোফিলিয়াস শরীরের ব্যবচ্ছেদের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।প্রাচীন গ্রিস সভ্যতার নিকট আধুনিক বিশ্ব বিভিন্নভাবে ঋণী। ভাষা-সাহিত্য, দর্শন-ইতিহাস, বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখা তাদের করস্পর্শে সমৃদ্ধ হয়েছে। গ্রিক পণ্ডিতদের প্রভাব বিশ্বের সকল দেশ ও জাতির নিকট অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।

প্রশ্ন: গ্রিক সভ্যতার বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা কর ।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments