Homeইতিহাসপ্রাচীন মিসরীয় সভ্যতা

প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতা

প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতা (The Ancient Egyptian Civilization)

নীলনদের অববাহিকা মিসর ও এর সন্নিকটবর্তী এলাকায় উন্নত ও এক বৈভবময় সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতাকে গ্রিক ঐতিহাসিক হিরোডোটাস ‘নীলনদের দান’ আখ্যা দিয়েছিলেন। এর কারণ নীলনদ ছিল এই সভ্যতার প্রাণ। দক্ষিণ-উত্তরে প্রবহমান এর বয়ে আনা পলিমাটি দিয়ে মিসরে কৃষিভিত্তিক সমাজ গড়ে ওঠে। আজ থেকে আনুমানিক সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে সেখানে বিকশিত হয় মিসরীয় সভ্যতা। শুধু কৃষিই নয়, নীলনদকে কেন্দ্র করে মিসরীয় সভ্যতার পুরো অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে উঠেছিল।
দেশ ও সমাজ : ৫০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মিসর উচ্চ (উত্তর) ও নিম্ন (দক্ষিণ) মিসরে বিভক্ত ছিল। দুটো অঞ্চল মিলে ৪০টি নোম বা নগর ছিল। এসময়কালের মিসরকে বলা হয় প্রাক-রাজবংশীয় যুগ। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২০০ অব্দে ফারাও মেনসের নেতৃত্বে দুই অঞ্চল একত্র হয়। শুরু হয় প্রথম রাজবংশের শাসনকাল। ৩১টি রাজবংশ প্রায় ৩০০০ বছর প্রাচীন মিসরে রাজত্ব করেছে। এ রাষ্ট্রের প্রথম রাজধানী ছিল থিবিসে পরে তা মেমফিসে স্থানান্তরিত হয়।
প্রাচীন মিসরীয় সমাজে আমরা কতিপয় পেশাভিত্তিক শ্রেণির সাক্ষাৎ পাই। এঁরা রাজপরিবার, পুরোহিত, অভিজাত ব্যবসায়ী, লিপিকর শিল্পী এবং কৃষক-ভূমিদাস প্রভৃতি ভাগে বিভক্ত ছিল। মিসরীয় সমাজে সর্বোচ্চ স্তরে অবস্থান ছিল শাসক সম্প্রদায় ও রাজপরিবারের সদস্যবৃন্দ। পুরোহিতগণ ছিলেন বেশ প্রভাবশালী, লিপিকরদের সামাজিক মর্যাদা ভালো ছিল। তবে শ্রমজীবী, কৃষক ও ভূমিদাসদের অবস্থা ভালো ছিল না। এরা সমাজে সবচেয়ে নিম্নস্তরের বিবেচিত হতো।
ধর্মবিশ্বাস : প্রাচীন জাতিসমূহের মধ্যে মিসরীয়রা ধর্মীয় বোধে উজ্জীবিত হয়ে প্রথম ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রচলন শুরু করে। তাঁরা সূর্য, চাঁদ, বজ্র, ঝড়, বন্যা, বায়ু এবং পশুর মধ্যে বাঘ, সিংহ, সাপ, কুমির, হরিণ, বাজপাখি, বাঁদর এমনকি বিড়ালের পূজা করত। এর মধ্যে সূর্যদেবতা ‘রে’ ছিলেন প্রধান। ফারাও চতুর্থ আমেন হোটেপ বহু দেব-দেবীর পূজার পরিবর্তে, ‘এটন’ নামক এক দেবতার উপাসনা প্রবর্তন করেন। এভাবে একেশ্বরবাদী ধারণা চালু হয়।মিসরীয়রা বিশ্বাস করত যে, মানুষের মধ্যে ‘বা’ অর্থাৎ আত্মা এবং ‘কা’ অর্থাৎ দ্বিতীয় সত্তা আছে। মৃত্যুর পর ‘বা’ ও ‘কা’ ফিরে এসে দেহকে পুনরুজ্জীবিত করবে। তাদের ধর্মবিশ্বাস মতে, পরানে ওসিরিসের সামনে উপস্থিত হয়ে কৃতকার হিসাব দিতে হবে। ধর্ম পালন করার জন্য মিসরে মন্দির নির্মাণের কথা প্রচলিত ছিল। মন্দিরের মধ্যে কারনাক মন্দির, হাটশেপস্যুটের মন্দির ও আবু সিম্বিলির মন্দির প্রসিদ্ধ ছিল।
অর্থনৈতিক জীবন : মিসরীয় অর্থনৈতিক কাঠামো কৃষির উপর নির্ভর করেই গড়ে উঠেছিল। মিসরের উর্বর ভূমিতে পর্যাপ্ত ফসল জন্মাত। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩০০ অব্দে মিসরীয়রা লাঙলের ব্যবহার শুরু করলে কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। জলসেচ, জলাশয় সৃষ্টি এবং কৃষিক্ষেত্রে বিভিন্ন কলাকৌশল উদ্ভাবনে তারা অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে। বব, তুলা, পেয়াজ ইত্যাদি ছিল তাদের অন্যতম কৃষিজাত পণ্য। মিসরীয় অর্থনীতির অন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল বাণিজ্য। ইন্ডিয়ান দ্বীপ, এটি ফিনিশিয় প্যালেস্টাইন ও সিরিয়ার সাথে নিসরের বাণিজ্য প্রসারিত ছিল। ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে জনসাধারণের একটা বড় অংশের শিল্প-কলকারখানায় কর্মসংস্থান হয়। ধীরে ধীরে শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিকাশ ঘটতে থাকে।
ফারাও ইখনাটনের সময় ফারাও পুরোহিতরা দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে পড়েন। তারা এক-সপ্তমাংশ চাবাযোগ্য জমি, প্রচুর গরু ও ভেড়া লাভ করতেন। পুরোহিতরা দেশের শিল্পকারখানার উপর কর্তৃত্ব আরোপ করতে থাকেন। এভাবে ধীরে ধীরে মিসরীয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো ভেঙে পড়ে ।
শাসন ব্যবস্থা : পুরোহিতরা শাসন ব্যবস্থার শিরোমণি ছিলেন। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী রাজা ঈশ্বরের প্রতিনিধিত্ব করতেন। রাজা নিজেকে মনে করতেন সূর্যদেবতা ‘রে’ (Re) এর পুত্র। মিসরের রাজাদের উপাধি ছিল কারাও বা ফেরাউন। ফেরাউন শব্দটি ফারাও-এর আরেক রূপ। ফারাও শব্দটি “পের-অ” শব্দ থেকে উৎপত্তি হয়েছে। অর্থ সুবৃহৎ বাসগৃহ বা রাজপরিবার হতে। রাজকীয় পরিবারের বাইরে ফারাওরা বিয়ে করতে পারতেন না। ধারণা করা হয় যে, তাতে তাদের ঐশ্বরিক রক্ত বিশুদ্ধ–থাকত এ মর্মে রাজপরিবার হতে রাজা নির্বাচিত হতেন। “পের অ” বা কারাও বা ফেরাউন শব্দটির তত্ত্বা এখানেই নিহিত।
ফারাও এর প্রধান কর্মকর্তা ছিলেন পুরোহিত। নানা সুবিধা ও কর্তৃত্ব আরম্ভে রাখার জন্য কারাও নিজে প্রধান পুরোহিতের ভূমিকা পালন করতেন। অন্য কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী, হিসাবাধ্যক্ষ, একজন প্রধান স্থপতি, পরিদর্শক ও একজন বিচারপতি ছিলেন। অধিকন্তু ৪২ জন ভূস্বামী সরকার পদ্ধতিতে সংযুক্ত ছিলেন। গ্রিকদের অনুকরণে রাষ্ট্রের অধীনস্থ বিভিন্ন নগররাষ্ট্রে এসময় ফারাও কর্তৃক গভর্নর নিয়োজিত হতো ।

সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতি : প্রাচীন মিশরীয় শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল উন্নত। বর্ণভিত্তিক চিত্র লিপির উদ্ভাবন মিসরীয়দের গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এ ধারার লিখন পদ্ধতিতে এক একটি চিত্র অক্ষরের বিকল্প হিসেবে মনের ভাব প্রকাশ করত। এ লিখন পদ্ধতি হায়ারোগ্লিফিক (Hieroglyphic) নামে পরিচিত। এ পদ্ধতিতে ২৪টি চিহ্ন ছিল এবং প্রতিটি চিহ্ন একটি বিশেষ অর্থ নির্দেশ করত। বিস্ময় উদ্রেককারী তাদের লিখন পদ্ধতি তিন ভাগে বিভক্ত ছিল। যথা : চিত্রভিত্তিক (pictographic), অক্ষরভিত্তিক (syllabic) এবং বর্ণভিত্তিক (alphabetic)। ব্যঞ্জনধ্বনি মুক্ত এক ধরনের লেখাকে হায়ারেটিক (hieratic) বলা হতো । পুরোহিতরা ধর্মীয় কাজে এ লিপি ব্যবহার করত। ব্যঞ্জনধ্বনি যুক্ত লিপি চালু হওয়ার ফলে লিখন শিল্পে বিপ্লব সৃষ্টি হয়। ব্যঞ্জনধ্বনি যুক্ত লিপিটি ডেমোটিক (demotic) নামে অভিহিত হয়। শিক্ষা ব্যবস্থার মূল ভিত্তি ছিল চিত্র লিখন পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত লেখকগোষ্ঠী। পড়ালেখা ও অঙ্ক শাস্ত্র নিয়েই পূর্ণাঙ্গ পাঠক্রম তৈরি হতো
লিখন পদ্ধতি আবিষ্কারের ফলে মিসরীয়দের মনোবিকাশের দ্বার উন্মোচিত হয়। আদেশনামা, ধর্মের বাণী প্রভৃতি লিখন প্রয়োগে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পাথর বা কাঠের গায়ে প্রথমে লিপি খোদাই করা হতো। নলখাগড়া জাতীয় প্যাপিরাস নামীয় এক প্রকার উদ্ভিদ থেকে কাগজ তৈরি করার রীতি চালু হয়। নরম কার্বন আঠা আর পানি মিশিয়ে মিসরীয়রা কালো কালি তৈরির পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। তাদের সাহিত্য মূলত ধর্ম ও দর্শনভিত্তিক ছিল। লিখন পদ্ধতির সূচনালগ্ন থেকে মিসরীয় সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি হতে থাকে। মৃতদের পুস্তক ‘বুক অব ডেড’ (book of dead)-এর ইখনাটন কর্তৃক সূর্যদেবতার স্তুতি উল্লেখযোগ্য সাহিত্য।নবপোলীয় যুগে আবিষ্কৃত বর্ষপঞ্জির দুর্বলতা নির্ণয় করে আধুনিকীকরণের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসা মিসরীয় সভ্যতার আর একটি অবদান। ফি-বছর নীলনদের প্লাবন তথা কৃষির প্রয়োজনে প্রাকৃতিক অবস্থা নিরূপণের লক্ষ্যে এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি।
স্থাপত্য : মিসরীয় সভ্যতার অপরূপ উপহার তাদের স্থাপত্যকর্ম। বিস্ময়কর প্রকৌশল জ্ঞানের যথার্থ প্রয়োগ দেখা যায় তাদের স্মৃতিসৌধ ও ধর্মমন্দিরে। স্মৃতিসৌধের অনন্য উদাহরণ হলো পিরামিড। এটি প্রাচীন স্থাপত্যবিদ্যার বিস্ময়কর নিদর্শন।
চিত্র : পিরামিড ও স্ফিংক্‌স
পিরামিডের ভিত্তি সমচতুর্ভুজ। এর উপরের দিকে চারপাশ ছোট হতে হতে ত্রিভুজ আকারের হয়ে এক বিন্দুতে মিশেছে। পিরামিড ছাড়া প্রাচীন মিসরের আরও যে দুটো জিনিস অমর কীর্তির স্বাক্ষর হিসেবে টিকে আছে, সেগুলো হলো স্ফিংকস ও মমি। বহু পাথরের গায়ে তা খোদাই করা। স্ফিংকস-এর দেহ সিংহের মতো আর মস্তক ফারাও এর মতো। এগুলো ছিল মর্যাদা ও শক্তির প্রতীক।
মিসরীয়রা প্রাচীনকালে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে মৃতদেহ সংরক্ষণ করত। তারা বিশ্বাস করত মৃত্যুর পর মানুষ পুনরুজ্জীবিত হবে এবং এজন্য তাঁরা মরদেহকে সংরক্ষণ করত। বৈজ্ঞানিক উপায়ে সংরক্ষিত এ মৃতদেহকে মমি বলা হতো । অনাদিকাল পর্যন্ত টিকে থাকার অভিনব পদ্ধতি আর কোথাও দেখা যায় না। মিসরীয় সভ্যতার এটি একটি উল্লেখযোগ্য দিক। চিত্রকর্ম ও কারুশিল্প : চিত্রকর্ম ও কারুশিল্পে মিসরীয়দের অবদান অনস্বীকার্য। সমাধিসৌধ ও মন্দির সজ্জায় লতাপাতা ও জ্যামিতিক নকশার মনোহর পরিবেশনা দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছে। থিবিসে নির্মিত মন্দিরগাত্রে এ ধরনের অসংখ্য দেয়াল চিত্রও দৃষ্ট হয়। প্রযুক্তি জ্ঞানের প্রয়োগ পেশাগত দিক থেকে কারুশিল্পে মিসরীয়দের জুড়ি ছিল না। রঙিন মাটির পাত্র সোনার অলঙ্কার, খোদাইকৃত আসবাবপত্র, হাতির দাঁতের তৈজসপত্র, বাদ্যযন্ত্র, খেলনা ও সূক্ষ্ম লিলেন কাপড় ইত্যাদি তৈরিতে দক্ষ ছিল।
জ্ঞান-বিজ্ঞান : প্রাচীন মিসরীয়দের মাঝে মুক্তবুদ্ধির চর্চা ছিল। তাদের সমুদয় চিন্তা-চেতনা ধর্মের পরিসীমায় আবদ্ধ ছিল না। দার্শনিক ও মুনি-ঋষিগণ অনন্ত বিশ্বচরাচরে বিশ্বাসী ছিলেন। নৈতিকতা বিষয়ক রচনা ম্যাক্সিম গ্রন্থে গভীর দার্শনিক তত্ত্বের পরিচয় মেলে। দর্শন ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় মিসরীয়দের অবদান অতুলনীয়। অঙ্কশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিদ্যায় তাদের অগ্রগতি বিস্ময়কর। তারাই সর্বপ্রথম অঙ্ক ও জ্যামিতি শাস্ত্রের উদ্ভাবন করেন। যোগ-বিয়োগ, গুণ, ভাগ ও দশমিক প্রথার প্রবর্তন করেন।
জ্যামিতি শাস্ত্রে তারাই প্রথম কৌণিক, আয়তক্ষেত্র ও ষড়ভুজের আবিষ্কার করেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানেও ছিল তাদের অপরিসীম জ্ঞান। সে সময় মিসরে চোখ, দাঁত, প্লীহা রোগের সুচিকিৎসা ছিল। নাড়ি ও হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন ও কার্যাবলি সম্বন্ধে তাদের জ্ঞান ছিল। জোয়ার-ভাটা, নদ-নদীর গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে তারা জানত ।মিসরীয় সভ্যতার উন্মেষ ও বিকাশ আধুনিক সভ্যতার মূলভিত্তি রচনা করে। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, আইন, শাসন ও সরকার পদ্ধতির উদ্ভাবন ও বিন্যাস সাধন যুগোপযোগী কর্মধারার সূচনা করেছিল। সেখান থেকে ধার করে প্রাচ্য- প্রতীচ্যের সকল সভ্যতার দিক নির্দেশনা লাভ করেছিল। এ প্রসঙ্গে প্রফেসর সেইসের মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, “We are the heirs of the civilize past and a goodly position of civilize that past was the creation of ancient Egypt.” অর্থাৎ আমরা প্রাচীন সভ্যতার নিকট ঋণী এবং উক্ত প্রাচীন সভ্যতার অধিকাংশই ছিল মিসরীয়দের সৃষ্টি।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments