প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতা (The Ancient Sumerian Civilization)
সুমেরীয়, আক্কাদীয়, ব্যবিলনীয়, আমুরীয়, অ্যাসিরীয়, ক্যালদীয় ইত্যাদি অন্যতম। এর মধ্যে সুমেরীয় সভ্যতা সবচেয়ে প্রাচীন। তাই সুমেরীয়দের মেসোপটেমীয় সভ্যতার স্রষ্টা মনে করা হয়। গ্রিকদের দেওয়া নাম সুমের অর্থ কালো মানুষ ৷ অসেমেটিক, সুমের জাতির নামানুসারে নাম হয় সুমেরীয় সভ্যতা। মেসোপটেমিয় অঞ্চলে সুমেরীয় সভ্যতার উন্মেষ ঘটে। নবোপলিয় যুগে খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০০ অব্দে সুমেরীয়দের আবির্ভাব ঘটে।
দেশ ও সমাজ : সুসভ্য জাতির প্রতীক হলেও তারা কতিপয় কারণে সুসংহত রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে নি। সভ্যতাটি নগররাষ্ট্রভিত্তিক ছিল। ইরিদু, নিপুর, কিস, লাগাস, উর, আল উবাইদ প্রভৃতি প্রাচীরবেষ্টিত নগরকেন্দ্রিক এ সভ্যতায় একজন রাজা ও স্বনির্বাচিত দেবতা ছিল। নগররাষ্ট্রের প্রধানকে ‘পতেজি’ বলা হতো, রাষ্ট্রপ্রধান নিজেই সেনাধ্যক্ষ, কর্মাধ্যক্ষ ও সেচকার্যের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। সুমেরুদের সমাজে নানা বিভক্তি ছিল। সমাজের উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত ছিল পুরোহিত, অভিজাত শ্রেণি, বণিক, শিল্পমালিক ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। মধ্য শ্রেণিভুক্ত ছিলেন চিকিৎসক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়িগণ ;
কৃষক, শ্রমিক ও ভূমিদাসগণ নিম্নশ্রেণিভুক্ত ছিল। নারীরা সমাজে উঁচু মর্যাদা ভোগ করত। পিতার সম্পত্তিতে পুত্র ও কন্যার করত।। সমান অংশ ছিল।
ধর্মবিশ্বাস : সুমেরীয়গণ নানা দেব-দেবীতে বিশ্বাসী ছিলেন। তারা প্রাকৃতিক শক্তিকে দেবতা জ্ঞানে পূজা করত। তাদের দেব-দেবী ছিল সূর্যদেবতা শামাস, চন্দ্র দেবতা নানান, বায়ু ও বৃষ্টির দেবতা এনলিল, উর্বরতার দেবী ইশতার, প্লেগ দেবতা নারগল ও পানির দেবতা এনকি উল্লেখযোগ্য। সুমেরীয়দের ধর্মমন্দিরকে ‘জিগুরাত’ বলা হতো। এরা পরকালে বিশ্বাস করত না। দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে মানুষ ও পশু বলি দিত। কুফিন ছাড়াই মৃতদেহ বাসগৃহের নিচে সমাহিত করত।
শাসনব্যবস্থা : একটি গতিশীল ও নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে সুমেরীয় নগররাষ্ট্র (city states) পরিচালিত হতো। রাজতান্ত্রিক ধারায় একটা চমৎকার সরকার ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। নগররাষ্ট্রগুলো স্বাধীনভাবে শাসিত হতো, যার প্রধানকে বলা হতো পাতেশী (putesi)। তিনি একাধারে রাষ্ট্রপ্রধান, সামরিক বাহিনীর সবাধিনায়ক, প্রধান পুরোহিত। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য কিছুসংখ্যক বুদ্ধিদীপ্ত অভিজাত ও ভূস্বামী যুগলদের সমন্বয়ে কাউন্সিল গঠন করা হতো। এরা সম্ভবত আধুনিককালের স্বরাষ্ট্র ব্যবস্থার আদলে কার্যক্রম পরিচালনা করত। এদের মাঝে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বজায় থাকলেও সুশৃঙ্খল জীবনাচারে সবাই আগ্রহী ছিল। সুমেরীয় সম্রাট ডুঙ্গীর আইন প্রণয়ন কার্যক্রম তার প্রমাণ বহন করে।
অর্থনৈতিক জীবন : সুমেরীয়দের অর্থনৈতিক কাঠামো ছিল সচ্ছল। কৃষি ছিল অর্থনীতির প্রধান উৎস আর দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল বাণিজ্য। তারা খাল কেটে প্রথম সেচ ব্যবস্থার আবিষ্কার করে। ভোঁতা কৃষি যন্ত্রের বদলে ধাতুর লাঙল, কোদাল, কাস্তে, নিড়ানির ব্যবহার করে উন্নত কৃষি সভ্যতা গড়ে তোলে। কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগ কৃষি উৎপাদনে বিপ্লব সাধিত হয়। ব্যবসায়-বাণিজ্যে সুমেরীয়রা বিশেষ সাফল্য অর্জন করেছিল।
সমুদ্র ও স্থলপথে তারা কাঠ, নীলকান্ত মণি, লাল পাথর ইত্যাদি আমদানি করত এবং রপ্তানি করত বয়নজাত দ্রব্য, যুদ্ধাস্ত্র প্রভৃতি। সিন্ধু, আফগানিস্তান, পারস্য, সিরিয়া, প্যালেস্টাইন, আনাতোলিয়া, ফিনিশিয়া, ক্রীট এবং মিসরের সাথে তাদের বাণিজ্য ছিল। সুমেরীয়রা আধুনিককালের মতো কিছু নিয়মকানুন ও আইন প্রবর্তন করে। তারা ব্যবসায় ক্ষেত্রে বিল, রশিদ নোট ও ঋণপত্রের ব্যবহার প্রচলন করে। পাশাপাশি দরপত্র ও সিলের ব্যবহার চালু করে।
সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতি : মানব সভ্যতার বিকাশে সুমেরীয়দের অবদান অসামান্য। তারা চিত্রলিপির মাধ্যমে লিখন পদ্ধতির প্রচলন করে এবং বিজ্ঞানে নতুন নতুন বিষয় আবিষ্কার করে। চিত্রলিপির মাধ্যমে তাদের লিখন পদ্ধতিকে কিউনিফর্ম বলা হয়। প্রথমে ২০০০ পরে ৬০০ ও আরও পরে ৩৫০টি চিহ্ন সংবলিত এ লিখন পদ্ধতি পরবর্তীতে ব্যবিলনীয়, অ্যাসিরীয় ও পারস্য সভ্যতায় অনুসৃত হয়। সুমেরীয়দের শ্রেষ্ঠ অবদান মহাকাব্য ‘গিলগামেশ কাব্য’। এটি ১২টি বড় মাটির ফলকে লেখা। এতে উরুক নগর, রাষ্ট্রের রাজা গিলগামেশের বীরত্ব ও কৃতিত্ব বর্ণিত হয়েছে।
আইন প্রবর্তন : সুমেরীয় যুগে কিছু বিধিবদ্ধ আইন বা Code চালু ছিল। সুমেরীয় সভ্যতার অন্যতম অবস্থান বিধিবদ্ধ আইন প্রণয়ন করা। বদলা আইন অর্থাৎ “চোখের বদলে চোখ” “হাতের বদলে হাত” “দাঁতের বদলে দাঁত” “পায়ের বদলে পা” অপরাধী যে-অপরাধ সংঘটিত করবে তাকে সে অপরাধের অনুরূপ শাস্তি ভোগ করতে হবে। অপরাধীকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বিচারকের নিকট উপস্থিত করত। বিচারক বাদী বিবাদীর মধ্যে যথাসাধ্য মীমাংসা করে দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন এবং অপরাধীকে শাস্তিদান করতো। সুমেরীয় সমাজে সকল মানুষ সমান ছিলেন না বিদায় শাস্তি আভিজাত, সাধারণ এবং ৫. সার্ফদের ভিন্ন ভিন্ন ছিল
জ্ঞান-বিজ্ঞান : প্রকৃত জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা শুরু হয় সুমেরীয়দের আমলে পানি দ্বারা চালিত জলঘড়ি, স্বর্ণঘড়ি এবং চন্দ্র পঞ্জিকার আবিষ্কার, গুণ-ভাগের পদ্ধতি, ওজন ও পরিমাপ প্রবর্তন ও প্রচলন বিশ্বসভ্যতার অগ্রগতিতে অনন্য। ২৪ ঘণ্টায় ১ দিন, ৭ দিনে ১ সপ্তাহ এবং ৬০ মিনিটে ১ ঘণ্টা তারাই নিরূপণ করেন। সুমেরীয় পুরোহিতরা সূর্য ও চন্দ্রের আপেক্ষিক অবস্থিতি নির্ণয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পাশাপাশি তারা গ্রহেরও সময় নির্দেশ করেন। ভেষজ চিকিৎসায় সুমেরীয়দের সাফল্য অসামান্য। ঔষধ পঞ্জিকা সংক্রান্ত চিকিৎসাবিষয়ক উপাত্ত তার প্রমাণ বহন করে। সুমেরীয়দের বিখ্যাত উদ্ভাবন হচ্ছে চাকা আবিষ্কার। চাকা আবিষ্কারের পর খুব দ্রুত মেসোপটেমীয় সভ্যতার অগ্রগতি সাধিত হয়। পাশাপাশি তা মানব সভ্যতার উন্নতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসে।
স্থাপত্য ও ভাষ্কর্য শিল্প : সুমেরীয়গণ ধাতব দ্রব্য, মূর্তি ও ভাস্কর্য নির্মাণে সুদক্ষ ছিল। মেয়েরা নানাবিধ শিল্পকর্মে সিদ্ধহস্ত ছিল। স্তরে স্তরে নির্মিত ধর্মমন্দির জিগুরাত সুমেরীয় স্থাপত্য শিল্পের এক অপূর্ব নিদর্শন ।চিত্রকর্ম ও কারুশিল্প : সাধারণত ধাতব দ্রব্য, খোদাই মূর্তি এবং ভাস্কর্যে সুমেরীয় চিত্রকলার প্রকাশ ঘটে। তাদের বাস্তবধর্মী চিত্রের প্রকাশ ঘটে যুদ্ধাস্ত্র, পানপাত্র, অলঙ্কার এবং মানুষ বা জন্তুর প্রকৃতিতে।