বাংলাদেশের নামকরণ কবে কিভাবে ;বাঙালি জাতি এবং যে ভূখণ্ড নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠিত হয়েছে তার রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। বর্তমানে যে ভূখণ্ডকে বাংলাদেশ হিসেবে অভিহিত করা হয় তা এক সময় একক কোনো দেশ ছিল না। ঐতিহাসিককাল থেকেই বাংলা অঞ্চল বিভিন্ন জনপদে বিভক্ত ছিল। প্রত্যেক অঞ্চলের ছিল আলাদা নাম ও শাসন কাঠামো বর্তমান ভারতের পশ্চিম বাংলাসহ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল বঙ্গ, রাঢ়, পুণ্ড্র, বরেন্দ্র, গৌড়, সমতট, হরিকেল ইত্যাদি জনপদে বিভক্ত ছিল। ব্রিটিশ আমলে এই সকল জনপদ নিয়ে গঠিত হয় বাংলা প্রদেশ (Bengal Presidency)। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে প্রদেশটি পূর্ব বাংলা ও আসাম এবং বাংলা প্রদেশ নামে দুটি আলাদা প্রদেশে বিভক্ত হয়। অবশ্য ১৯১১ সালে তা রদ করে পুনরায় একটি প্রদেশে পরিণত করা হয়। বর্তমানে পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশের পূর্ব বাংলা অঞ্চলটি বাংলাদেশ নামে পরিচিত। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় পশ্চিম বাংলা ভারতে থেকে যায়। বর্তমানে তা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ নামে পরিচিত। আর পূর্ব বাংলার সাথে সিলেট অঞ্চল যুক্ত হয়ে পূর্ব পাকিস্তান গঠিত হয়। ১৯৭১ সালে এই অঞ্চলটি স্বাধীন হয়ে বর্তমান বাংলাদেশ গঠিত হয়। ফলে বর্তমান বাংলাদেশের বাইরে ও এর আশপাশের একটি ব্যাপক এলাকার লোক বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের বাইরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র এবং বিহার, উড়িষ্যা, ত্রিপুরা, আসাম প্রভৃতি অঞ্চলের প্রায় ২২ কোটি লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে। এর ফলে বাংলা ভাষাভাষী লোকজনের বিস্তৃতি অন্যান্য প্রদেশেও রয়ে যায়। নরগোষ্ঠীগত দিক থেকে বাংলাদেশের লোকজন মিশ্র নরগোষ্ঠীর বলে নৃবিজ্ঞানীরা মনে করেন এবং এর সপক্ষে বিভিন্ন তথ্য প্রমাণ হাজির করেন। ভাষার ক্ষেত্রে বাংলাকে ইন্দো- ইউরোপীয় গোষ্ঠীর বলে পণ্ডিতরা মত দেন। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এদেশের প্রধান দুই জাতি হিন্দু ও মুসলিমদের সংস্কৃতি প্রায় অন্তঃপ্রবিষ্ট এবং উদার চরিত্রের। দুই জাতিই একে অন্যদের উৎসবে সোৎসাহে যোগদান করে। অনেকক্ষেত্রে ধর্মীয় রীতিনীতির সাংস্কৃতিক রূপান্তরের মাধ্যমে এখানে একপ্রকার ধর্মীয় সহনশীলতা ও সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা লক্ষ করা যায়। এভাবে দেখা যায়, বাংলাদেশ এবং বাঙালি জাতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জনগণকে অনেক ঐতিহাসিক পথ পাড়ি দিতে হয়েছে।
বাংলাদেশের নামকরণ
Naming of Bangladesh
বাংলার ইতিহাস বহু প্রাচীন হলেও বাংলা নামের উৎপত্তি বিষয়ে ঐতিহাসিক মতভিন্নতা রয়েছে। আমরা আজ যে জনগোষ্ঠীকে বাঙালি এবং যে ভূখণ্ডকে বাংলা বা বাংলাদেশ বলে জানি তা আধুনিক কালের। প্রাচীনকালে এদেশে একক নামের ও অভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষের কোনো পরিচয় মেলে না। তবে এতদঞ্চলে কতিপয় প্রাচীন জনপদের উল্লেখ পাওয়া যায়। তন্মধ্যে একটি জনপদের নাম বঙ্গ। ঐতিহাসিকদের একাংশের মতে, বাংলা নামের উদ্ভব হয়েছে এই বঙ্গ থেকে। আর বঙ্গ এসেছে ব থেকে। তাদের মতে, ‘বঙ’ একটি প্রাচীন জাতির নাম যারা ভাগীরথী নদীর তীরে বসবাস করতো। বঙ্গ (বঙ্গাবগধাশ্চের পাদাঃ) নামের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকে রচিত ‘ঐতরেয় আরণ্যক’ গ্রন্থে) খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীর ভাষ্যে পতঞ্জলি সুহ্মাঃ, পুণ্ড্রাঃ, বঙ্গাঃ এর উল্লেখ করেছেন। প্রাচীন মহাভারত, পুরাণ ও হরিবংশ প্রভৃতি গ্রন্থেও বঙ্গের উল্লেখ পাওয়া যায়। মহাভারত থেকে প্রথম স্পষ্ট জানা যায়, পূর্ব ভারতীয় অঞ্চল কয়েকটি জনপদে বিভক্ত ছিল। শ্লোকে বলা হয়েছে,
“অঙ্গো বঙ্গ: কলিঙ্গশ্চ পুণ্ড্র: সুহ্মাশ্চাতে সুতাঃ। তেষাং দেশা সমাখ্যাতাঃ স্বনাম কথিতা ভূমি ॥ (১৮/১০)
মহাভারতে আখ্যান অনুযায়ী, প্রাচ্যদেশীয় চন্দ্রবংশোদ্ভব রাজা বলিরাজের পঞ্চপুত্র অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র, সুহ্ম এর নামানুসারে উক্ত রাজ্যসমূহ জগদ্বিখ্যাত হয়েছে। ‘বোধায়ন ধর্মসূত্রে’ পুণ্ড্রের ও বঙ্গের অবজ্ঞার্থে উল্লেখ রয়েছে। খ্রিষ্টজন্মের পর যে গ্রন্থটিতে বঙ্গ নাম পাওয়া যাচ্ছে তা হচ্ছে টলেমির ভূগোল। আনুমানিক খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে উত্তর ভারতের কোশাম্বীর নিকটে পভোসায় প্রাপ্ত একটি গুহালিপিতে ‘বঙ্গপাল’ নামের রাজার উল্লেখ রয়েছে।
বাদশাহ আকবরের সভাসদ ঐতিহাসিক আবুল ফজল তাঁর আইন-ই-আকবরি গ্রন্থে বলেছেন ‘বঙ্গ’ শব্দের সঙ্গে ‘আল’ শব্দ যুক্ত হয়ে (বঙ্গ+আল) বঙ্গাল বা বাঙ্গালা নামের উদ্ভব হয়েছে। ‘আল’ বলতে সীমা বা বাঁধ বুঝায়। অতীতে পাহাড়ের পাদদেশে তৈরি ১০ হাত উঁচু ও ২০ হাত চওড়া স্তূপকে বলা হতো ‘আল’। ড. নীহাররঞ্জন রায় আবুল ফজলের ব্যাখ্যাকে অযৌক্তিক মনে করেননি। তবে ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার তাঁ মানতে রাজি ছিলেন না। তাঁর মতে, প্রাচীন শিলালিপিতে বঙ্গ ও বঙ্গাল নামে দুটি দেশ পাওয়া যায়। তিনি মনে করেন, বঙ্গ থেকে নয় বরং বঙ্গাল থেকে বাঙ্গালা নামের উদ্ভব হয়েছে। তবে একথা সত্য যে, বাংলার প্রাচীন জনপদসমূহের মধ্যে ‘বঙ্গাল’ এর তুলনায় ‘বঙ্গ’ অধিক খ্যাতিমান ও গুরুত্বপূর্ণ ছিল ।
(এতে বোঝা যায় বঙ্গ এর সাথে বাংলা নামের উদ্ভবের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ৷ ঐতিহাসিক মিনহাজ-ই-সিরাজ তার বিখ্যাত ‘তবকাত-ই-নাসিরি’ গ্রন্থে মুসলমানদের বাংলা বিজয়কালে এ অঞ্চলকে ‘বঙ্গ’ নামে উল্লেখ করেছেন। তার পরবর্তী ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারাণি সর্বপ্রথম বঙ্গ অর্থে ‘বাঙ্গালাহ’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। ইবনে বতুতার বৃত্তান্তেও বঙ্গ-এর পরিবর্তে বাঙ্গালার ব্যবহার লক্ষণীয়। ১৩৩৮ সনে সুলতান শামসউদ্দীন ইলিয়াস শাহ গৌড় বিজয় করেন এবং শাহ-ই-বাঙ্গালাহ উপাধি ধারণ করে সিংহাসনে আসীন হন। বাদশাহ আকবরের (১৫৫৬-১৬০৫) আমলে ভারতের পূর্ব দক্ষিণাঞ্চলের এক বিস্তৃত ভূখণ্ড ‘সুবাহ-ই-বাঙ্গালা’ নামে পরিচিত ছিল। পর্তুগিজদের কাগজপত্রে ‘বেঙ্গালা ( Bengala ), এবং পরবর্তীতে ইংরেজগণ এ থেকে বেঙ্গল
দেশ ও জনগোষ্ঠীর পরিচয়
(Bengal) নামকরণ করে। বিটিশ ভারতে বাংলা প্রদেশ (Bengal presidency ) ছিল একটি বৃহৎ প্রদেশ ছিল। ১৮৫৪ সালে বড়লাট লর্ড ডালহৌসি নতুন বাংলা প্রদেশের সূচনা করেন। বিহার, উড়িষ্যা, ছোট নাগপুর তখন বাংলা প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল । ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের ফলে বাংলা প্রদেশ বিভক্ত হয়ে পশ্চিম বাংলা প্রদেশ ও পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশ নামে দুটো প্রদেশ গঠিত হয়। ১৯৫৬ পর্যন্ত এ নাম প্রচলিত ছিল। পাকিস্তান আমলে ১৯৫৬ সালে সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে এতদঞ্চলকে পূর্ব বাংলার পরিবর্তে পূর্ব পাকিস্তান নামকরণ করে। ‘বাংলাদেশ’ নামটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীর এক আলোচনা সভায় তিনি এ নামটি ব্যবহার করেছেন। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পল্টনে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগের এক জনসভায় এবং বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বাংলাদেশ নামটি উচ্চারিত হয়েছে। ১৯৭১ সালে ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণায় ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, হিসেবে এদেশের নামকরণ করে। এভাবে বঙ্গ থেকে বাংলাদেশের নামকরণ হয়।