Homeইতিহাসহিব্রু সভ্যতা (The Hebrew Civilization)

হিব্রু সভ্যতা (The Hebrew Civilization)

হিব্রু সভ্যতা (The Hebrew Civilization)

মরুভূমিকে ঘিরে সৃষ্ট হিব্রু সম্প্রদায় সেমিটিক জাতিরই একটি শাখা। প্রচলিত একটি মতে, খাবিরু বা হাবিরু নাম থেকে হিবু নামকরণ হয়েছে। অপর মতে, ইভার থেকে শব্দটি এসেছে। এগুলোর অর্থ নিম্নবংশীয় বা যাযাবর ভ্রাম্যমাণ গোষ্ঠী। যাহোক, তদানীন্তন সভ্যজাতিগুলোর মধ্যে হিব্রুগণ একটি বিশিষ্ট স্থান দখলকরে আছে।

দেশ ও সমাজ : শুরুতে হিব্রুরা প্যালেস্টাইন ও সিরিয়ায় প্রতিষ্ঠা লাভ করলেও এদের আদিপুরুষ ইব্রাহিমের নেতৃত্বে মেসোপটেমিয়ায় বসতি স্থাপন করেন। পরে তাঁর পুত্র (ইয়াকুব আ.)-এর নেতৃত্ব সংঘটিত হয়। ইয়াকুবের অপর নাম ইসরাইল। ইয়াকুবের অব্যবহিত পরে খ্রিষ্টপূর্ব ১৩৩০-৫০ অব্দে হযরত মুসা (আ.) হিব্রুদের পুনরায় সংঘবদ্ধ করেন। তিনি দাসত্বের শৃঙ্খল হতে মুক্ত করে প্যালেস্টাইনে উন্নত সভ্যতার দ্বার উন্মোচন করেন। প্যালেস্টাইন ব্যবসায়-বাণিজ্যের পাশপাশি অর্থনীতিতে কৃষি ও পশুপালনে প্রাধান্য পায়। ফলে সমাজ নগরবাসী কৃষক ও পশুপালক শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। আর একটি অংশ ছিল পুরোপুরি যাযাবর বা বেদুইন। এরা পূৰ্ব ও দক্ষিণাঞ্চলীয় মরুভূমির প্রান্তিক ভূখণ্ডে বসবাস করত। হিব্রু শাসকদের মধ্যে ডেভিড (দাউদ আ.) ও তাঁর পুত্র সলোমান (সোলায়মান আ.) জেরুজালেম অধিকার করে এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। হিব্রুদের সময় দাস প্রথার ব্যাপক প্রচলন ঘটে। রাজা ও মন্ত্রীদের জমিতে দলবদ্ধভাবে দাসদের নিয়ে অত্যাচারের মাধ্যমে কাজ করানো হতো । দাউদ (আ.)-এর আমলে দাসশ্রমের অবসান ঘটে। তাঁর নেতৃত্বে হিন্দুদের জাতীয়তাবাদের ও জাতীয় ঐক্যের সূচনা হয়। তিনি বিভিন্ন জাতির লোকদের ঐক্যবদ্ধ করে সুশৃঙ্খল ও অংশীদারিত্বমূলক সমাজ বিনির্মাণে সবিশেষ ভূমিকা রাখেন। ফলে ন্যায় ভিত্তিক সুসংবদ্ধ সমাজ গড়ে উঠে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে হিব্রু জাতির বিশেষ অবদান হলো তাদের ধর্মীয় চিন্তার উন্নতি। নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে হিব্রু ধর্মবিশ্বাস প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তাদের মাঝে একেশ্বরবাদী ভাবধারা প্রতিষ্ঠার ফলে অন্ধকার যুগেও আলোক বর্তিকা হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। হিব্রুধর্ম নৈতিক মানদণ্ডকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করে। তারা ‘জেহেবাকে’ একেশ্বর আইন প্রদানকারী ও নৈতিক আদর্শের প্রতীক জ্ঞান করত। তারা বিশ্বাস করে যে, ভবিষ্যতে একজন মহামানবের আবির্ভাব ঘটবে। তিনি সমগ্র মানবজাতির ত্রাণসাধন করবেন। ক্রমশ তারা শেষ বিচারের দিন এবং পরলোকে বিশ্বাসী হয়। শেষ বিচারের দিন ও একেশ্বরবাদিতার সরল রেখা অনুকরণ করে খ্রিষ্টান ও ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব ঘটে। স্টুয়ার্ড ইস্টন বলেন, “Both Christianity and Islam have adopied a considerable portion of the Hebrew religious in sights as theiar OWTL. ” হিব্রুদের ধর্মীয় গ্রন্থের নাম  তাওরাত নামে পরিচিত ।

অর্থনৈতিক জীবন : হিব্রুদের অর্থনীতি প্রাকৃতিক সম্পদ, পশুপালন বা গোচারণের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। প্যালেস্টাইনে পানি সেচ ব্যবস্থা অত্যন্ত জটিল ও সমস্যাসংকুল ছিল। কারণ দেশটির অধিকাংশ অঞ্চল পর্বতময় এবং সেখানে উপরিস্থিত পানির অভাব ছিল। কিন্তু বৃষ্টির পানি ব্যবহারের দ্বারা কোনো কোনো এলাকায় গম ও যব এবং অন্যান্য খাদ্যশস্য ও বৃক্ষলতার চাষাবাদ হতো। উঁচু পার্বত্য এলাকায় ব্যাপক ভিত্তিতে ভেড়া ও ছাগল চরানো হতো। ব্যবসায়-বাণিজ্য, কৃষি এবং পশু পালনের যথেষ্ট উন্নতি ঘটে। হিব্রু অর্থ ব্যবস্থার উন্নতিতে করব্যবস্থার প্রবর্তন একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সেখানে ধনী অঞ্চলগুলোকে বেশি এবং দরিদ্র অঞ্চলগুলোকে কর্ম কর দিতে হতো।

শাসন ব্যবস্থা : আইন-শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনাচারে অভ্যস্ত হিব্রুরা আইনের দ্বারা সুনিয়ন্ত্রিত হতো। ইতিহাস খ্যাত হাম্বুরাবি আইন অপেক্ষা তাদের আইন উন্নত ছিল। দাসমুক্তি, নিঃস্বদের স্বার্থরক্ষা, ভোজবাজির নিন্দা ও সুদপ্রথা রহিতকরণে উৎসাহ প্রদান তাদের আইনের প্রতিপাদ্য ছিল। হিব্রু আইনের ধারাবাহিক সংগ্রহ তালমুদ একটি উল্লেখযোগ্য সাহিত্য নিদর্শন।

সাহিত্য ও দর্শন : সাহিত্য ও দর্শনে হিব্রুদের অবদান উল্লেখযোগ্য। ধর্মভিত্তিক সাহিত্যদর্শনের সার হিব্রুধর্মগ্রন্থ ওল্ড টেস্টামেন্টে নিহিত ছিল। এছাড়া ধর্ম, বীরত্ব গাঁথা বহু-প্রেম ইত্যাদি ছিল হিব্রু সাহিত্যের বিষয়বস্তু। তাঁদের সাহিত্যের অনন্য নিদর্শন হলো ‘Book of Job’ বা জবের পুস্তক। পুস্তকটিতে অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে মানুষ, শয়তান ও ঈশ্বরের চরিত্র এবং  ভূমিকা বিধৃত হয়েছে। পরবর্তী পুস্তক ধর্মসঙ্গীত (The Book of Psalms) অত্যন্ত সুধাময় সাহিত্যিক নিদর্শন। গ্রিকদের পূর্বেই হিব্রুরাই বিস্ময়কর দর্শনের জন্ম দিতে পেরেছিল। এ দর্শন বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, মানুষ ও জীবন সম্পর্কে নতুন ধারণার অবতারণা করে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের গঠন প্রকৌশল, অদৃষ্টবাদ, সন্দেহবাদ, দুঃখবাদ ও পরিমার্জনা প্রভৃতি তাদের দর্শনের বিবেচিত বিষয় ছিল।

চিত্রকর্ম ও কারুশিল্প : চিত্রশোভিত সীল হিব্রু সভ্যতার চিত্রকর্মের অনন্য উদাহরণ। সুমেরীয় ও হিটাইট প্রভাবে খোদিত এসকল শিল্পকর্ম হিব্রু সভ্যতাকে বিশিষ্টতা দান করেছে ।

স্থাপত্য ও শিল্পকলা : স্থাপত্য ও শিল্পকলায় হিব্রু সভ্যতার অবদান অনস্বীকার্য। স্থাপত্য ও শিল্পকলা কীর্তির অসংখ্য নিদর্শন হিব্রুরা রেখে গেছেন। জেরুজালেম নগরীর সুরম্য প্রাসাদ, অট্টালিকা, রাজপথ তৎকালীন বিশ্বের বিস্ময় ছিল। একটি গুহার অভ্যন্তরে পঞ্চাশটি মৃৎপাত্রে চামড়ার উপর হিব্রু ভাষায় লিখিত ডেড সী স্কুল বা মরুসাগরের দস্তাবেজ হিব্রু সভ্যতার শিল্পকর্মের গভীরতা ও বৈশিষ্ট্যকেই নির্দেশ করে। আধুনিক সভ্যতার সৃষ্টিতে হিব্রু সভ্যতার প্রভাব বিদ্যমান। তাদের সরকার ব্যবস্থা, আইনের সার্বভৌমত্ব এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও ব্যক্তির অধিকারের স্বীকৃতি আধুনিক গণতন্ত্র বিকাশে উৎসাহ যুগিয়েছে।

 

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments